হবিগঞ্জে পৈত্রিক ভিটায় এসে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছেন তিনি
শাহ ফখরুজ্জামান ॥ হবিগঞ্জ শহরের প্রখ্যাত আইনজীবী
প্রমোদ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য ১৯৪৮ সালে দেশ বিভাগের সময়
সপরিবারে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। ৫ বছরের শিশু প্রশান্ত
কুমার ভট্টাচার্য্য তখন সবে লেখাপড়ার হাতেখড়ি শুরু
করে। কয়েকজন সমবয়সীর সাথে খেলাধূলা করা আর
বাড়ির পাশে খোয়াই নদীতে জ্যাঠাই মশাইর সাথে সাতার
শিখত প্রতিদিন। সেই অবুঝ বয়সের স্মৃতি তার কাছে এখনও
অমলিন। তাই নাড়ীর টানে পৈত্রিক ভিটা দেখতে ৬৪ বছর
পর তিনি চলে আসেন হবিগঞ্জে। কোন ঠিকানা আর পূর্ব
যোগাযোগ ছাড়াই হবিগঞ্জ শহরে আসার পর স্ত্রী দিপালী
ভট্টাচার্য্যসহ হোটেল সোনারতরীতে উঠেন। পরে পৈত্রিক
ভিটা খোঁজে ব্যাপক অনুসন্ধান করার পর জানতে পারেন
তিনি যে হোটেলে উঠেছেন তার পিছনের জায়গাটিই নিজের
পৈত্রিক ভিটা।
হোটেল সোনারতরীতে ড. প্রশান্ত কুমার ভট্টাচার্য্যরে সাথে
দেখা হলে তিনি খুলে দেন তার স্মৃতির ঝাপি। আলাপ হয়
অনেক বিষয়েই। ভারতে বসবাস করলেও মনে এখনও
লালন করেন বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ট
ভূমিকা রাখেন তিনি। এখনও ২১ ফেব্র“য়ারি দিল্লীতে তিনি
জাঁকজমকপূর্ণভাবে ভাষা দিবস পালন করেন।
ড. পি কে ভট্টাচার্য্য ইন্ডিয়ার শিা বিভাগের উচ্চপদস্থ
কর্মকর্তা। কলকাতার যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী নেয়ার পর দিল্লীর আইআইটি থেকে
পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের পর কর্মজীবন শুরু করেন। বিভিন্ন
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি শিা বিভাগের বড়
কর্মকর্তা ছিলেন। ৩০ বছর বয়সে তিনি যখন পিএইচডি
অধ্যয়নরত তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তার নেতৃত্বে দিল্লীতে
অর্থ ও কাপড় সংগ্রহ শুরু হয়। জনমত গঠনের জন্য তিনি
লাখো মানুষের স্বার সংগ্রহ করে ইন্দিরা গান্ধীকে
দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডন
থেকে দিল্লী আসেন তখন তাঁর সম্মানে কারার ওই
লৌহকপাট গানটি পরিবেশন করে পি কে ভট্টাচার্য্যরে নেতৃত্বে
প্রগতি নামে একটি দল। তিনি ১৯৭২ সালে ভারতে বিজ্ঞান
শিা জনপ্রিয়করণে ভ্রাম্যমান বিজ্ঞান প্রয়োগশালা নামে
একটি মডেল তৈরী করেন। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী
বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিা জনপ্রিয় করতে এই মডেল কাজে
লাগানোর জন্য তাকে নির্দেশ দেন।
গত ২৩ ডিসেম্বর তিনি এ দেশে এসে প্রথমে চলে যান
কক্সবাজারে। সেখান থেকে গত ২৫ ডিসেম্বর তিনি হবিগঞ্জে
আসেন। দীর্ঘ ভ্রমণ কান্তির পরও তিনি হবিগঞ্জে এসেই
খোঁজতে থাকেন খোয়াই নদীকে। অনেক কষ্টে খোয়াই নদী
পেলেও কোথায় তার জন্মভিটা তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরে
চলে যান কালীবাড়িতে। সেখানে তার কথা শুনে হবিগঞ্জ
সরকারি মহিলা কলেজের প্রভাষক ইষু ভুষন দাশ, শিক
দিলীপ চৌধুরী, বুদ্ধ ও বিজন তাকে সহায়তার হাত বাড়ান।
পুরান মুন্সেফী এলাকার বয়স্ক লোকজনের কাছে গেলে তারা
তার জন্মভিটা খুজে বের করে দেন। জন্মভিটায় এসে তার
উপলদ্ধি- মনে হয় মায়ের কোলেই আছি।
এই জন্মভিটা নিয়ে তার অনেক স্মৃতি। বাড়ির ৮০ গজ দূরে
খোয়াই নদীতে বর্ষাকালে ২/৩টি বাচ্চার মৃত্যু হত। বৃষ্টির
সময় খৈ মাছের লাফালাফি। চারিদিকে সুপারী গাছ আর
বাড়ির সামনেই জমিদার চন্ডেশ্বর চৌধুরীর বাড়ি। তার
মেয়ে টুকু আর তমাল ছোট বেলার সাথী। রাতের বেলা
বাড়ির পিছনে শেয়ালের ডাক আর বর্ষায় ব্যাঙের ডাক
তার কাছে এখনও জীবন্ত ঘটনাই মনে হয়। তাকে পাথরের
থালায় অ আ লেখা শেখাতেন জ্যাঠা মশাই পুর্ণ চন্দ্র শ্বাস্ত্রী।
তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল্ড মেডেলিস্ট। গৌহাটি
কলেজসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিকতা করেছেন। পরে
বেনারসে সাংস্কৃতিক পন্ডিত হিসাবে শ্বাস্ত্রী খেতাব পান।
পি কে ভট্টাচার্য জানান, তার পিতা ১৯৬১ সালে মারা
যান। মৃত্যুর পুর্বে তিনি দেশে আসার জন্য কেদে বুক
ভাসাতেন । আশায় বুক বাধতেন দুই বাংলা আবার এক
হবে। দেশে ফেরার আশায় তিনি বাড়ীতে তালা দিয়ে ইন্ডিয়ায় গিয়েছিলেন।
পি কে ভট্টাচার্য্য গত ২৬ ডিসেম্বর যান গ্রামের বাড়ি
বানিয়াচঙ্গ উপজেলার বিদ্যাভুষন পাড়ায়। এই বিদ্যাভুষন
হল তার পিতামহ। সেখানে অনেক আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা হয় তার।
৪ দিনের সফর শেষে গতকাল শুক্রবার তিনি দেশে ফিরেন।
তবে সাথে নিয়ে যাচ্ছেন জন্মভূমির এক মুঠো মাটি। আর
হবিগঞ্জের মানুষের ভালবাসা তাকে মুগ্ধ করেছে। যাকে
তিনি চিনেনই না তারাও পরম আত্মীয়ের মত আদর
করেছে। যা ভারতে বিরল ঘটনা। এই ভালবাসায় তিনি
আবারও হবিগঞ্জে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
ভিতরের পাতা
|
No comments:
Post a Comment